আর্থিক প্রতিবেদন দেখে কিভাবে বুঝবেন শেয়ারের দর বাড়বে?

এস. এম. হোসেন
বৃহস্পতিবার , ১৮ ফেব্রুয়ারী ২০১৬

কেন শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করবেন? যখন এখানে বিনিয়োগ ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু আসলেই কি বিষয়টি তাই! শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করা যে জুয়া খেলা নয় তা এর আগে আলোচনা করেছি। বরং দেখে শুনে বুঝে বিনিয়োগ করলে অন্যান্য সব বিনিয়োগ থেকে শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ অনেক বেশি লাভজনক। বিশেষ করে ব্যাংকে টাকা রাখার চেয়ে-তো বটেই!

শেয়ারে বিনিয়োগের মাধ্যমে লভ্যাংশসহ বহুবিধ প্রাপ্তির সম্ভাবনা থাকে। এজন্য সংশ্লিষ্ট সকল বিষয় আপনাকে বিবেচনা করতে হবে। মনে করা যাক, একটি কোম্পানি ডিসেম্বর মাসে ১০ শতাংশ লভ্যাংশ প্রদান করবে। আপনি যদি শেয়ারটি অক্টোবর মাসে ১ তারিখে ক্রয় করেন তাহলে ৩ মাস পরেই ১০শতাংশ লভ্যাংশে পাওয়া যাবে। এক্ষেত্রে বাৎসরিক (১২ মাস) প্রাপ্তির হার দাঁড়াবে ৪০ শতাংশ।

অন্যদিকে আপনার যদি  নিজের একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান থাকে এবং সেখান থেকে ২০শতাংশ লাভ আসে তাহলে সমুদয় লাভ উঠিয়ে না নিয়ে প্রতিবছর লাভের কিছু অংশ আপনি ঐ শিল্প প্রতিষ্ঠানটির ভবিষ্যৎ সম্প্রসারণের জন্য রিজার্ভ হিসেবে রাখতে পারেন। একটি প্রতিষ্ঠানের মালিকানার অংশ বা শেয়ার ক্রয়ের সুবাদে আপনি যেমন লভ্যাংশ পাচ্ছেন তেমনি লাভের যে অংশটি রিজার্ভ বা উদ্বৃত্ত খাতে জমা হচ্ছে সেটিতেও আনুপাতিক হারে আপনার মালিকানা থাকবে। এ কারণে রিজার্ভ বা উদ্বৃত্ত এবং সম্প্রসারণ কর্মসূচির বিষয়াবলিও বিশেষভাবে বিনিয়োগকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। উপরন্তু এক্ষেত্রে মূলধনী লাভের সম্ভাবনাও থাকতে পারে। এসব বিষয়ে আগাম ধারণা লাভের জন্য কোম্পানির সম্পদ ও সাফল্য- ব্যর্থতার প্রতিবেদন বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে আপনাকে দক্ষ হতে হবে।
প্রশ্ন হলো শেয়ার ব্যবসায়ের জন্য আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করা কেন প্রয়োজন?

প্রকৃত পক্ষে শেয়ার দর বৃদ্ধি রহস্যের মূল সূত্র বা ক্লু আর্থিক প্রতিবেদনের মাঝে লুকিয়ে থাকে। এই সূত্র বা ক্লু খুঁজে বের করার জন্যই আপনাকে আর্থিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণে দক্ষ হতে হবে।

প্রকৃত লাভ কত দ্রুত এবং সঙ্গতিপূর্ণভাবে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হচ্ছে, ঋণ ও নিজ মূলধন অনুপাত সহনীয় মাত্রায় রয়েছে কিনা, লভ্যাংশ প্রদানের রেকর্ড কেমন, পিই রেশিও কেমন, সঞ্চয় ও উদ্বৃত্তের পরিমাণ, শেয়ার সংখ্যা, অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন, পরিচালকদের মন্তব্য ইত্যাদি সহ শেয়ারের দর হ্রাস বৃদ্ধি বিষয়ক বহুবিধ তথ্য আমরা আর্থিক প্রতিবেদন থেকে পেতে পারি। বিরল ব্যতিক্রম ব্যতীত বিভিন্ন শেয়ারের চূড়ান্ত তুলনামূলক বাজার দর দক্ষ হিসেবের ভিত্তিতে শেয়ারের অন্তর্নিহিত শক্তি অনুযায়ী ন্যায়ানুগভাবে নিধারিত হয়। তাই গুজবের ভিত্তিতে নয় বরং আর্থিক প্রতিবেদনের এসব তথ্য বিচার বিশ্লেষণের মাধ্যমে অন্তনিহিত শক্তিভিত্তিক ভবিষ্যৎ দর হ্রাস বৃদ্ধি বিষয়ক ধারণা নিয়ে শেয়ার ক্রয় বিক্রয়ের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করাই হলো শেয়ার ব্যবসাতে টেকসই জয়ী হওয়ার মূলমন্ত্র।

আর্থিক বিবরণীতে প্রকাশিত বিষয়াবলী কিভাবে শেয়ারের দর হ্রাস বৃদ্ধির ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে সে বিষয়ে আলোচনা করার জন্য আর্থিক বিবরণীতে প্রকাশিত তিনটি বিষয় নিচে আলোচনা করা হলো।

ব্যালান্সশীট বা উদ্বৃত্ত পত্র
লাভ ক্ষতির বিবরণী
নগদ তহবিল প্রবাহ

ব্যালান্স শীট বা উদ্বৃত্ত পত্র
ব্যালান্সশীট (স্থিতিপত্র) মিলানোর কথা শুনলে অনেকের কাছে দুর্বোধ্য এক বিষয়ের চিত্র ফুটে উঠে অথচ শেয়ার ব্যবসায়ী হিসেবে আপনাকে ব্যালান্সশীট বুঝতে হবে। আবার অনেকের কাছে ইংরেজি শব্দগুলি দুর্বোধ্য মনে হয় অথচ অনেক ক্ষেত্রে ইংরেজিতেই বার্ষিক/অর্ধ-বার্ষিক প্রতিবেদনসমূহ প্রণয়ন করা হয়। এ সকল বিষয় আমরা নিচে সহজবোধ্যভাবে আলোচনা করেছি।

ব্যালন্সশীট দুর্বোধ্য হলেও আপনার জন্য সুখবর রয়েছে। সেটি হলো আপনাকে ব্যালান্সশীট তৈরি করতে হবে না। লাভ ক্ষতির প্রতিবেদন বা নগদ প্রবাহ তহবিল প্রতিবেদনও তৈরি করতে হবে না। বরং কোম্পানির তৈরি ঐ সব প্রতিবেদন থেকে আপনার জন্য প্রয়োজনীয় তথ্য বা দিক নির্দেশনা গ্রহণ করতে হবে। কেউ কেউ বলবেন এসব তথ্য ভিত্তিহীন বা ভুয়া। সকল কোম্পানির জন্য ঢালাওভাবে সৃষ্ট এহেন ধারণা নেতিবাচক মনোভাবপ্রসূত।

উদাহরণ স্বরূপ: একটি কোম্পানির শেয়ার প্রতি আয় শতকরা ৪০ টাকা এবং লভ্যাংশ প্রদানের হার শতকরা ৩০ টাকা। ৩০ টাকা লভ্যাংশ প্রাপ্তির পরেও কি ঐ কোম্পানির তথ্য সম্পূর্ণভাবে ভূয়া এমন ধারণা পোষণ করা ঠিক হবে? নির্দিষ্ট একটি কোম্পানির কোনো নির্দিষ্ট হিসেব বছরের সম্পদ (এ্যাসেট) ও দায় দেনার (লায়বিলিটি) বিবরণীকে ব্যালান্সশীট বা স্থিতিপত্র বলা হয়। তালিকাভুক্ত কোম্পানির বার্ষিক বা অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদনসমূহের ব্যালান্স শীটে সম্পদ ও দায়-দেনা শব্দ দুটি অনেক সময় ব্যবহার না করে দায়-দেনার বিবরণীকে অর্থের উৎস (সোর্স অব ফান্ড) এবং সম্পদকে অর্থের প্রয়োগ (অ্যাপলিকেশন অব ফান্ড) হেডিংয়ে দেখানো হয়।

আধুনিক হিসাব বিজ্ঞানের ভিত্তি হলো দূ’তরফা দাখিলা পদ্ধতি। দু’তরফা দাখিলা পদ্ধতিতে টাকার পরিমাপযোগ্য প্রতিটি লেনদেন দ্বৈত সত্তায় প্রকাশ করা হয়। সহজ ভাষায় লেনদেনের একটি হিসাব দ্বারা যে পরিমাণ অর্থ সুবিধা গ্রহন করা হয় দেনাদার হিসেবে অন্য হিসাব দ্বারা পাওনাদার হিসেবে সে পরিমাণ সুবিধা প্রদান করা হয়। সুবিধা গ্রহণকারী হিসাবকে ডেবিট এবং সুবিধা প্রদানকারী হিসাবকে ক্রেডিট বলা হয়। এজন্য ডেবিট এবং ক্রেডিট সমান হয়ে উদ্ধৃত্ত পত্রের উভয় দিক মিলে যায়।

উদাহরণ স্বরূপ কোম্পানির ব্যবসাকে যদি একটি কৃত্রিম ব্যক্তি হিসেবে চিন্তা করেন তাহলে আপনি যখন আপনার কোম্পানি বা ব্যবসাতে টাকা বিনিয়োগ করবেন বা অন্য কোন সূত্র থেকে কোম্পানি বা ব্যবসাতে টাকা/সম্পদ যোগ হবে তখন কৃত্রিম ব্যক্তি হবে দেনাদার এবং আপনি বা যে সূত্র থেকে অর্থ/সম্পদ গৃহীত হয়েছে সেই সূত্র হবে পাওনাদার।

এক্ষেত্রে কৃত্রিম ব্যক্তিটির সম্পদ হবে পাওনাদারদের নিকট তার দায়ের সমান; অর্থাৎ হিসাব সমীকরণটি হবে ,
সম্পদ (এ্যাসেট) = দায় (লায়বিলিটি)
অথবা এ (এ্যাসেট) = এল (লায়বিলিটি)

এল (দায় বা লায়বিলিটি) এর মধ্যে অন্তভূক্তঃ
পাওনাদারদের দাবী সংক্ষেপে এল (লায়বিলিটি)
এবং
মালিকদের স্বত্তাধিকার বা মূলধন (প্রোপাইরেটরশিপ) সংক্ষেপে পি
তাই হিসাব সমীকরণটি বর্ধিতরূপে লেখা যায়-
এ = এল + পি
ব্যবসায়ের আয় ও ব্যয় দ্বারা মালিকের মূলধন (পি) এর হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে। এই দৃষ্টিকোন থেকে পি কে যদি সি-ক্যাপিটাল (মূলধন) ধরি এবং সি(মূলধন) এর হ্রাস বৃদ্ধির কারণগুলো বিচার করি তবে সমীকরণটির বর্ধিতরূপ হবে-

এ = এল + পি
অথবা এ = এল + (সি + আই – ই)
অথবা এ = এল + সি + আই – ই
অথবা এ + ই = এল + সি + আই

এক্ষেত্রে,
এ ( অ্যাসেট)= সম্পদ
ই (এক্সপেনস) = খরচ
এল (লায়বিলিটি)= পাওনাদারদের দাবী
সি( ক্যাপিটাল) = মূলধন
আই (ইনকাম) = আয় বা লাভ

এই সমীকরণে বর্ণিত সম্পদ, মূলধন, পাওনাদারদের দাবী, আয়, ব্যয় সম্পর্কিত তথ্য নিয়ে তৈরি হয় উদ্বৃত্ত পত্র, লাভ ক্ষতির বিবরণী ও নগদ তহবিল প্রবাহ বিবরণী। উদ্বৃত্তপত্র বা ব্যালান্সশীটে কোম্পানির সম্পদ বা অর্থের ব্যবহার এবং দায় বা উক্ত অর্থের উৎস ব্যাখ্যা করা হয়। সাধারণত সম্পদ বা অর্থের ব্যবহার দেখানো হয় বাম দিকে এবং দায় বা অর্থের উৎস দেখানো হয় ডান দিকে। তবে তালিকাভূক্ত কোম্পানিসমূহের উদ্ধৃত্ত পত্রে বর্ণিত সম্পদ ও দায় সাধারণত উপর নিচে দেখানো হয়।

প্রিয় বিনিয়োগকারি, বিষয়টি বুঝতে হয়তো আপনাদের কাছে কিছুটা কঠিন মনে হতে পারে। কিন্তু মনোযোগ দিয়ে একবার, দুইবার, তিনবার পড়ুন। বিষয়টি খুবই সহজ হয়ে যাবে। সবচেয়ে বড় কথা, যেখানে আপনি অর্থ বিনিয়োগ করবেন সেখানে আপনাকে কষ্ট করে হলেও বিষয়টি বুঝতে হবে। তবে একবার বুঝলে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না। (আগামিকাল পড়ুন বাকি অংশ…)