শেয়ারের উচিত দর কিভাবে নির্ধারণ করব?

এস. এম. হোসেন
শুক্রবার , ১৫ জানুয়ারী ২০১৬

অনেক বিনিয়োগকারীর এই একই প্রশ্ন! শেয়ারের উচিত দর কিভাবে নির্ধারণ করব? কিভাবে বুঝবো যে দরে শেয়ারটি কেনা হচ্ছে এটাই একদম নায্যমূল্য।

আসলে একটি কোম্পানির শেয়ারের বাজার দর কত হওয়া উচিত এবং উচিত মূল্য অপেক্ষা কম মূল্যে কোন শেয়ার বিক্রী হচ্ছে তা বুঝতে হলে একজন বিনিয়োগকারীকে অবশ্যই ফান্ডামেন্টাল বিশ্লেষণে দক্ষ হতে হবে। শুধু দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগকারীদের ক্ষেত্রে নয়, ডে-ট্রেডারদের ব্যবসায়ে ঝুঁকি কমাতে এবং শেয়ার চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে ন্যূনতম ফান্ডামেন্টাল বিশ্লেষণ বিষয়ক জ্ঞান অর্জন করতে হবে।

কোনো কোম্পানির অন্তর্নিহিত শক্তির ভিত্তিতে একটি শেয়ারের দর কত হতে পারে তা নির্ধারণ করা সম্ভব হলে এমন কি চরম মন্দাবস্থায়ও ঝুঁকির মাত্রা কতটুকু তা নিরূপণ করে মুনাফা অর্জন করা সম্ভব। শেয়ার দরের উর্দ্ধমুখী ধারা টেকসই হওয়া, দর পতন বা দর স্থিতিশীল থাকার ক্ষেত্রে কোম্পানির ফান্ডামেন্টালই মুখ্য ভূমিকা পালন করে।

এক্ষেত্রে টেকনিক্যাল এ্যানালিসিসে দর ওঠানামার ধরন, গড়, চার্ট, বিচ্যুতি, সমর্থন স্তর, বিপরীতমুখিতা ইত্যাদির পরিবর্তে ফান্ডামেন্টাল বিশ্লেষক কোম্পানির পণ্য বা সেবার বাজার পরিস্থিতি, প্রতিযোগিতা, ব্যবসায়িক সম্ভাবনা, আয়, সম্পদের মূল্য, টেকসই এবং উন্নত প্রযুক্তি, লভ্যাংশ প্রদান নীতি, গবেষণা ও উন্নয়ন কর্মসূচি, শ্রম সম্পর্ক, শীর্ষ পর্যায়ের ব্যবস্থাপনার মান ইত্যাদি বিবেচনা করেন।

এই বিশ্লেষণের উদ্দেশ্য হলো কোম্পানির শক্তি এবং দুর্বলতাসমূহ চিহ্নিত করা এবং সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ভবিষ্যৎ পরিচালনা, ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য প্রাপ্তির প্রেক্ষাপটে এবং লাভ অর্জনের, লভ্যাংশের ক্ষেত্রে এসবের প্রভাব মূল্যায়ন করা। এই মূল্যায়নের ভিত্তিতে কোম্পানির শেয়ারের দর হ্রাস-বৃদ্ধি প্রাপ্তির শক্তি বিষয়ে নির্দেশনা পাওয়া যায়।
একটি কোম্পানির সম্পদ, আয় ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিষয়ে ধারণা লাভের জন্য প্রয়োজনীয় অনেক তথ্য আপনি সংশ্লিষ্ট কোম্পানির প্রসপেক্টাস এবং বার্ষিক-অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদন থেকে সংগ্রহ করতে পারেন।

বার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত কোম্পানি কর্তৃপক্ষের বক্তব্যও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিষয়ে ধারণা লাভ করার জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তবে অনেক সময় এসব বক্তব্যের তাৎপর্য একেক জনের কাছে একেক ভাবে ধরা পড়ে। ফলে বার্ষিক সাধারণ সভার ঐ বক্তব্যের পরে কেউ শেয়ারটি বিক্রী করে দেন, আবার কেউ শেয়ারটি ধরে রাখেন। এক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়ার কৌশলও আয়ত্ত্ব করতে হবে।

জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পরিসরের বিভিন্ন ঘটনাবলিও অনেক সময় কোনো কোনো বিশেষ কোম্পানির ফান্ডামেন্টালকে সবল বা দুর্বল করে তোলে। তাই এ বিষয়টিও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।

প্রিয় বিনিয়োগকারী, প্রশ্ন জাগতে পারে, শেয়ার ব্যবসায়ীদের জন্য কোম্পানির ফান্ডামেন্টাল বিবেচনার বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ কেন?

বিশ্বের সব শেয়ার বাজারেই কোনো কোনো বিশেষ শেয়ার দর ২০০ থেকে ৫০০% বৃদ্ধির ঘটনাও মাঝে মধ্যে ঘটে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আমেরিকান অন লাইন নামক ইন্টারনেট সেবাদানকারী একটি কোম্পানির শেয়ারের দর ১৯৯৮ সনে ২০ ডলার থেকে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে দাঁড়ায় ১২১ ডলারে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের অনেক শেয়ার বার্ষিক আয়ের ৪০ থেকে ৫০ গুণ বেশি দামেও বিক্রী হচ্ছে। ম্যাক্সওয়েল কম্পোজিট টেক্সটাইল এবং ইন্টেলিভিশন নামক কোম্পানি দুটির ২০০৫ সনের ৫২ সপ্তাহের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন দর ছিল যথাক্রমে ৪৯০/২০ এবং ১২২/৯ ভারতীয় রূপী।

বাংলাদেশের শেয়ার বাজারেও মাত্র ১ বছরের ব্যবধানে অনেক শেয়ারের দাম আকাশ ছুঁয়েছে…

কোম্পানির নাম                                 ১ বছরের (২০১৪-২০১৫)
সর্বনিম্ন দর        সর্বোচ্চ দর
এসি আই                                           ৩৪২                        ৬৬৫
ব্রাক ব্যাংক                                       ৩১.৫                        ৫২.৪
রেনেটা                                             ৮৭৩                      ১৩৫০

বাজার বিশেজ্ঞগণ, এমনকি দক্ষ শেয়ার ব্যবসায়ীরা এসব শেয়ারের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিষয়ে সর্বনিন্ম দরের স্তরে থাকা অবস্থায় সঠিকভাবে বুঝতে পেরেছিলেন!!! আপনার পক্ষেও এ ধরনের সম্ভাবনা বিষয়ে আগেই জানা সম্ভব। এ ধরনের দর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে কোম্পানিসমূহের অন্তর্নিহিত শক্তির (ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাসহ) বিষয়টি আপনাকে বুঝতে হবে।

প্রশ্ন জাগে, ১০ টাকা ফেস ভ্যালুর একটি শেয়ারের বার্ষিক আয় ৫ টাকা অথচ শেয়ার প্রতি আয়ের ৩০ গুণ বেশি দামে অর্থাৎ ১৫০ টাকা দরে ঐ শেয়ারটি বেচা কেনা হয় কোন যুক্তিতে। ব্যবসায়ীগণ যে দামে কিনছেন বা শেয়ারটিতে বিনিয়োগ করেছেন ঐ পরিমাণ অর্থ (১৫০ টাকা) আয় করতে কোম্পানির ৩০ বছর সময় লাগবে, তাই এতো বেশি দামে ক্রয় করা কি অযৌক্তিক নয়? উত্তর: সবক্ষেত্রে অযৌক্তিক নয়।

কোম্পানির যদি এমন কর্মসূচি বাস্তবায়নাধীন থাকে যে, সংরক্ষিত তহবিল থেকে বিনিয়োগ করে উৎপাদন ক্ষমতা সহসা ৫ গুণ বাড়িয়ে দেয়া হবে ফলে শেয়ার প্রতি আয়ও ৫গুণ বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়ে ২৫ টাকাতে দাঁড়াবে তাহলে ঐ দামে শেয়ারটি ক্রয় করা অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত। ১০ টাকার শেয়ারের বিপরীতে কোনো বিশেষ কোম্পানির শেয়ার প্রতি এমনকি ২০ টাকারও বেশি বার্ষিক আয়ের ঘটনা আমাদের শেয়ার বাজারে রয়েছে।

এ ধরনের সম্ভাবনার কারণে দক্ষ বাজারেও শেয়ারের দর কখনও কখনও অবমূল্যায়িত অবস্থা থেকে ৫০০-৭০০% পর্যন্ত বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। সংশ্লিষ্ট কোম্পানিসমূহের সম্পদ ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা এবং ক্ষেত্র বিশেষে কিছুটা অতি আশাবাদ এক্ষেত্রে কাজ করে। এধরনের বৃদ্ধি ব্যতিক্রমী ঘটনা হলেও সাধারণভাবে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ থেকে দক্ষ ব্যবসায়ীগণ কর্তৃক অর্জিত গড় লাভের পরিমাণ অন্যান্য যে কোনো আর্থিক হাতিয়ারে বিনিয়োগ ক্ষেত্র থেকে অর্জিত লাভ অপেক্ষা অনেক বেশি।

প্রিয় বিনিয়োগকারী, যে কোন সময়ের বাজার দর পর্যালোচনা করলে আপনি জানতে পারবেন সব সময়েই বিরল ব্যতিক্রম ব্যতীত সকল শেয়ারের দর নির্ধারিত হওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিসমূহের অন্তর্নিহিত শক্তির প্রভাব রয়েছে। এমনকি মন্দা সময়ের সবচেয়ে বেশি এবং কম দামী শেয়ার দুটির শেয়ার দরের তারতম্যের ক্ষেত্রেও একই শক্তি কার্যকর।

কোম্পানি ফান্ডামেন্টাল বা সম্পদ, আয় এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার ভিত্তিই হচ্ছে এ শক্তির উৎস। তাই ফান্ডামেন্টাল বিশ্লেষণে দক্ষ হলে কথিত ম্যানিপুলেটরদের সৃষ্ট ফাদে পা না দিয়ে অবমূল্যায়িত দরের অনেক সম্ভাবনাময় শেয়ারে বিনিয়োগ করে ভালো মুনাফা অর্জনের সুযোগ গ্রহণ করা সম্ভব এবং এক্ষেত্রে ঝুঁকির মাত্রাও থাকে সর্বনিম্নে।

একজন বিনিয়োকারীকে ফান্ডামেন্টাল বিশ্লেষণে কোম্পানির যে বিষয়গুলো দেখতে হবে তাহলো: ঐ কোম্পানির বা সেবার বিপণন বা ব্যবসায়িক সম্ভাবনা, কোম্পানির সম্পদ (উদ্বৃত্ত/ঘাটতিসহ), সম্পদের বণ্ঠন, ভবিষ্যৎ স¤প্রসারণের সম্ভাবনা ও সর্বশেষ দায় দেনার পরিস্থিতি; বিনিয়োগকৃত সম্পদ থেকে অর্জিত লাভ ও লভ্যাংশের হার, বিক্রী বা আয় হ্রাস-বৃদ্ধির ধারা, ঋণ এবং নিজ মূলধন কাঠামো, শেয়ার দর ও আয়ের অনুপাত (পিই রেশিও) ইত্যাদি।

এছাড়া প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার মতো কোম্পানির কারিগরী দক্ষতা, ব্যবস্থাপনার মান এবং সুনাম, বার্ষিক বা অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদনে বর্ণিত পরিচালক মন্ডলীর মন্তব্য, আন্তর্জাতিক বাজার পরিস্থিতি, মুক্তবাজার বিষয়ক বিশ্ববাণিজ্য সংস্থা ও আঞ্চলিক সংস্থাসমূহের সিদ্ধান্ত ইত্যাদি।

এই বিষয়গুলো বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগের জন্য শেয়ার নির্বাচন করলে সাফল্য আপনাকে হাতছানি দেবে।
এছাড়া শেয়ার দর নির্ধারণের কিছু হিসাব আছে, যা আগামি লেখাগুলোতে আমি তুলে ধরব…