কিভাবে মন্দা বাজার থেকে মুনাফা করবেন?

এস. এম. হোসেন
বৃহস্পতিবার , ১৪ জানুয়ারী ২০১৬

২০১০ সালের ভয়াবহ ধ্বসের পর মন্দাক্রান্ত শেয়ারবাজারে একদিন একটি ট্রেডিং হাউজে বসে আছি। একজন ডে-ট্রেডার বলছেন, ‘ব্যবসা ছেড়ে দেশে গিয়ে চাষাবাদ শুরু করবো।’ এমন হতাশা বহু ব্যবসায়ীর মাঝে দৃশ্যমান। দুজন শেয়ার ব্যবসায়ী চুপিসারে আলাপ করছেন, ‘আমরা পারছি না, কিন্তু ডাক্তার সাহেব প্রতিদিন দু’এক হাজার টাকা আয় করছেন। …. ওনার কপাল খুব ভালো।’

উক্ত ডাক্তার সাহেব ভাগ্যবান এটিই কিন্তু একজন অনুসদ্ধিৎসু ব্যবসায়ীর চূড়ান্ত মূল্যায়ন হতে পারে না। উনি কিভাবে আয় করছেন, কি কৌশলে আয় করছেন তা আপনাকে শিখতে হবে। মনে রাখবেন, ভালো ব্যবসায়িক ধারণা যে কোন সূত্র থেকেই আসতে পারে। সব জানি, কিংবা আমার সকল ধারণাই সবক্ষেত্রে সঠিক- এমন ধারণা পোষণ না করে আরও বেশি জানা বা শেখার জন্য সদা সচেষ্ট থাকুন। শুধু চাঙ্গা নয় কীভাবে মন্দা বাজার থেকেও মুনাফা অর্জন করতে হয় তা আপনাকে শিখতে হবে। কারণ, যারা মন্দা বাজার থেকে মুনাফা করতে পারেন তারাই প্রকৃত ব্যবসায়ী।

শেয়ার ব্যবসাতে যাদের সফলতা ঈর্ষণীয় সেসব ব্যবসায়ীরা ভবিষ্যৎ শেয়ার দর ওঠানামার ধরন (ট্রেন্ড), আবার বলছি কারণ নয় ধরন এবং একই সাথে কারণ বিষয়ে বহু কৌশলের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কোনো অবাস্তব তত্ত¡ কথা নয় বরং বাস্তবতার আলোকে যে সকল কৌশল অনুসরণ করে বহু ব্যবসায়ী সফলতা অর্জন করেছেন বা করছেন সেসব কৌশল আগামি লেখাগুলোতে আলোচনা করা হবে। যেকোন সময়ের যে কোন পরিস্থিতিতে সঠিক কৌশল প্রয়োগের দক্ষতা অর্জন করে আপনি সফল ব্যবসায়ী হয়ে উঠতে পারবেন। এজন্য প্রত্যেক শেয়ার ব্যবসায়ীকে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে শেয়ারের উচিত দর বা অন্তর্নিহিত শক্তিভিত্তিক দর নির্ধারণ বিষয়ে জ্ঞান অর্জন করতে হবে।

আমাদের শেয়ারবাজারে প্রায়ই ভবিষ্যৎ দরবৃদ্ধি বিষয়ক জল্পনা, ম্যানিপুলেশন কিম্বা এক শ্রেণীর ব্যবসায়ির অযৌক্তিক আগ্রহ শেয়ারের দর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। যদিও এ দর টেকসই হয় না তথাপিও এরূপ পরিস্থিতিতে বিশেষ কৌশল অবলম্বনে দক্ষ হলে এক্ষেত্রে এমনকি ম্যানিপুলেটরদের সুসংগঠিত চক্র অপেক্ষাও তুলনামূলক বেশি লাভ অর্জন করা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পক্ষেও সম্ভব।

কম দামে শেয়ার ক্রয় করে পরবর্তীতে ম্যানিপুলেশনের মাধ্যমে শেয়ারের দর বৃদ্ধি করে বাড়তি দামে ঐ শেয়ার বিক্রী করে লাভবান হওয়াই ম্যানিপুলেটরদের কৌশল। এক্ষেত্রে ম্যানিপুলেশনের সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও অবমূল্যায়িত দর বা দর হ্রাস-বৃদ্ধির মাঝে অপেক্ষাকৃত বেশি পার্থক্য সৃষ্টি হয় এমন শেয়ার চিহ্নিত করে ঐতিহাসিকভাবে কম দাম থাকা অবস্থায় সঠিক দরে যদি শেয়ারটি ক্রয় করতে সক্ষম হন তাহলে আপনার মত দক্ষ ব্যবসায়ীর জন্য ম্যানিপুলেটরদের অস্তিত্বও ক্ষতিকর হতে পারে না।

বাস্তবে বড় ব্যবসায়ী অপেক্ষা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের বাড়তি কিছু সুবিধা রয়েছে। অপেক্ষাকৃত কম পরিমাণ শেয়ার ধারন করার কারণে তাদের পক্ষে ন্যূনতম তারল্য রয়েছে এমন শেয়ার যেকোন পরিস্থিতিতে তাৎক্ষণিকভাবে চলতি বাজার দরে বিক্রী করা সম্ভব। অন্যদিকে বড় ব্যবসায়ীদের বৃহৎ পরিমাণের শেয়ার বিক্রীর চাপে তাদের সম্পূর্ণ শেয়ার বিক্রী হওয়ার পূর্বেই ঐ শেয়ারের দরপতন ঘটতে পারে।

শেয়ার বাজার বিষয়ক প্রচলিত ভ্রান্ত ধারণাসমূহ যেমন শেয়ার ব্যবসায়ীদের জন্য ক্ষতিকর তেমনি শেয়ার ব্যবসা বিষয়ক আধুনিক কৌশলের অস্তিত্ব বিষয়ে অসচেতনতাও শেয়ার ব্যবসায়ীদের জন্য আত্নঘাতী। তাই একজন শেয়ার ব্যবসায়ী হিসেবে আপনাকে আপনার জ্ঞানভান্ডার সমৃদ্ধ করতে হবে।

আগেই বলেছি, শেয়ার বাজারকে একটি যুদ্ধ ক্ষেত্রের সাথে তুলনা করা যেতে পারে যেখানে হিসেব নিকেশ ব্যতীত অপরিকল্পিতভাবে শেয়ার কেনা বেচা করছেন এমন শেয়ার ব্যবসায়ীদের আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত প্রতিপক্ষের সাথে খালি হাতে অসমযুদ্ধে লিপ্ত অসহায় সৈনিক হিসেবে বিবেচনা করা যেতে পারে।

যে কোন ব্যবসায়ে জয়ী হওয়ার সনাতন কৌশলটি আমরা সবাই জানি। কম দামে ক্রয় করে বেশি দামে বিক্রী করা। অতি সহজ এ তত্ত্বটি কিন্তু বাস্তবে কার্যকর করা বেশ কঠিন। বিশেষভাবে শেয়ার বাজারে। আমাদের পর্যবেক্ষণে দেখা যায় যে, এই সনাতন ব্যবসায়িক কৌশলটি জানা সত্তে¡ও বহু শেয়ার ব্যবসায়ী শেয়ার কেনা বেচার ক্ষেত্রে এর বিপরীত ধর্মী আচরণ করেন। এর পিছনে কাজ করে মূলত অদক্ষতা, আবেগ, হতাশা, লোভ, অধৈর্য মনোভাব ইত্যাদি।

প্রকৃতপক্ষে শেয়ার ব্যবসায়ে সফলতার জন্য অর্থনীতিশাস্ত্র, হিসাব বিজ্ঞান, পরিসংখ্যান, বিপণন বিদ্যা, মনোবিজ্ঞান এবং টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ বিষয়ে বেসিক জ্ঞানের প্রয়োজন। অবশ্য এজন্য ঐ সকল বিষয়ে বিশেষ ডিগ্রী অর্জন করার প্রয়োজন নেই। আপনার পরিচিত মহলের স্বল্প শিক্ষিত সফল ব্যবসায়ীদের জ্ঞানের পরিপক্বতার কথা ভাবুন। তাদের ন্যায় অনেকের পক্ষেই শেয়ার ব্যবসা সংক্রান্ত জ্ঞানের পরিপক্বতা অর্জন করা সম্ভব। সস্তা বা অবমূল্যায়িত শেয়ার ক্রয়ের জন্য এবং ঐ শেয়ার বিক্রী কিম্বা লভ্যাংশসহ অন্যান্য প্রাপ্তির মাধ্যমে লাভবান হওয়ার জন্য আপনাকে বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষাপটে শেয়ারের সঠিক দর কত হতে পারে তা জানতে হবে।

এই সঠিক ক্রয় বিক্রয় দরের বিষয়টি কিন্তু আপেক্ষিক। একজন ডে-ট্রেডারকে কোম্পানি ফান্ডামেন্টাল ন্যূনতম বিবেচনাতে নিয়ে শেয়ার দরের টেকনিক্যাল মুভমেন্ট লক্ষ্য করে ক্রয় বিক্রয় করতে হবে। অন্যদিকে মেয়াদী বিনিয়োগকারীকে মূলত কোম্পানি ফান্ডামেন্টাল বা শেয়ারের অন্তর্নিহিত শক্তি বিশ্লেষণের ভিত্তিতে নির্ধারিত দর অনুযায়ী শেয়ার ক্রয়-বিক্রয় করতে হবে।

কোম্পানির মৌলশক্তি, শেয়ার বাজারের সার্বিক চাঙ্গা এবং মন্দা ভাব, শেয়ার দরের চক্রক্রমিক ওঠানামার বিশেষ ছন্দ (!) সহ বিভিন্ন অবস্থার প্রেক্ষাপটে কোন বিশেষ শেয়ারের সঠিক ক্রয় এবং বিক্রয় মূল্য একজন ডে-ট্রেডার ও বিনিযোগকারীর কাছে বিভিন্ন সময়ে ভিন্নতর হতে পারে।

এক্ষেত্রে ক্রয় বিক্রয় মূল্য নির্ধারণের জন্য আপনাকে বিচারকের ভূমিকাতে অবতীর্ণ হতে হবে অর্থাৎ শেয়ারের অতীত দর ওঠানামার ধরন (ট্রেন্ড) এবং কারণ (অন্তর্নিহিত শক্তি বা মৌল শক্তি) বিবেচনার ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট সময়ের সকল পরিস্থিতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিশ্লেষণ করে শেয়ারের ন্যায্য দর বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

একটি বিশেষ সময়ে শেয়ার বাজারে কোন শেয়ারসমূহ সুপ্ত সম্ভাবনা নিয়ে অপেক্ষাকৃত কম বা অবমূল্যায়িত দরে বিক্রী হচ্ছে অথবা সহসা কোন শেয়ারটির বা শেয়ারসমূহের দর অপেক্ষাকৃত বেশি বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, কোন শেয়ারটির দর বিক্রী করার স্তরে পৌঁছেছে, এসব বিষয় মূল্যায়নে যিনি যতো বেশি দক্ষ তার ব্যবসায়িক সফলতা ততো বেশি।

একটি শেয়ারের বাজার দর কম বা অবমূল্যায়িত তা কোন কোন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে নির্ধারণ করবেন?
এক্ষেত্রে একজন বিনিয়োগকারীকে দেখতে হবে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ফান্ডমেন্টাল অর্থাৎ অন্তর্নিহিত শক্তিভিত্তিক মূল্য, ট্রেড চক্রের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিম্ন স্তর, সমমানের শেয়াসমূহের তুলনামূলক দর, শেয়ার বাজারের সার্বিক চাঙ্গা এবং মন্দাভাব ও শেয়ার বাজার বর্হিভূত প্রভাবকসমূহ বিশ্লেষণের প্রেক্ষাপটে শেয়ারের দর নির্ধারণ করতে হবে।

প্রিয়, বিনিয়োগকারী, আপনাকে বলছি, কোন গুজবে কান না দিয়ে একবার শুধু এইসব বিষয়গুলো বিচার বিশ্লেষণ করে শেয়ার কিনুন। তাহলে আর পেছন ফিরে তাকাতে হবে না…