শেয়ারের দর কেন বাড়ে? কখন বাড়ে? নাকি শুধু ম্যানিপুলেটরদের দ্বারাই শেয়ারের দর নির্ধারিত হয়!
প্রিয় বিনিয়োগকারী, আপনি যদি যে কোনো সময়ের শেয়ারের দর বৃদ্ধির ঘটনাসমূহ পর্যালোচনা করেন তাহলে দেখতে পাবেন, বিরল ব্যতিক্রম ব্যতীত শেয়ারের দর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বা যে কোনো সময়ের (চাঙ্গা এবং মন্দা উভয় বাজারে) বিভিন্ন শেয়ারের বিশেষ দরের স্তরে অবস্থান অথবা দর সংশোধন হওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির অন্তর্নিহিত শক্তির প্রভাব রয়েছে। এ প্রভাবের সম্ভাবনা বিষয়ে আগাম ধারণা লাভ করার ক্ষেত্রে আপনাকে দক্ষ হতে হবে।
কিভাবে দক্ষ হবেন সে বিষয়ে আগামী লেখাগুলোতে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। তবে মনে রাখবেন, ম্যানিপুলেটরদের দ্বারা প্রতিটি শেয়ারের দর নির্ধারিত হয় না। এ যুক্তির তাৎক্ষণিক প্রমাণ পাবেন, যে কোনো সময়ের সর্বোচ্চ এবং সর্বনিন্ম দরের শেয়ার দুটির, এমনকি তালিকাভুক্ত সকল কোম্পানির অন্তর্নিহিত শক্তির তুলনামুলকভাবে বিশ্লেষণের মাধ্যমে।
সর্বোচ্চ দামী শেয়ারধারী কোম্পানিটির মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানের মূলে থাকে তার ব্যবসায়িক সফলতার শ্রেষ্ঠত্ব, ব্যবস্থাপনার প্রতি মানুষের সুদৃঢ় আস্থা এবং উজ্জ্বল সম্ভাবনাময় ভবিষ্যৎ।
অন্যদিকে সর্বনিম্ন দরের শেয়ারের বিপরীতধর্মী অবস্থানের মূলে থাকে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ব্যবসায়িক ব্যর্থতা ও ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিষয়ে হতাশাব্যঞ্জক ধারণা। আবার মাঝে মধ্যে কোম্পানিসমূহের বাজার দরের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানেরও পরিবর্তন ঘটে থাকে। এক্ষেত্রে ব্যবসায়িক ব্যর্থতা কাটিয়ে টেকসই সফলতা অর্জন বা সফলতা অর্জনের সুষ্পষ্ট লক্ষণের ফলে সৃষ্ট সংশ্লিষ্ট কোম্পানির যোগ্যতার প্রশ্নটিই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। দক্ষ ও দুরদর্শী ব্যবসায়ীগণ এ ধরণের অবমূল্যায়িত শেয়ার অতি সস্তায় ক্রয় করে প্রচুর মুনাফা অর্জন করেন। এক্ষেত্রে ঝুঁকির পরিমাণও থাকে অতি নগণ্য।
তবে বাংলাদেশের শেয়ার বাজারে ম্যানিপুলেশনের কারণে কিম্বা বিশেষ কোনো শেয়ারের প্রতি ব্যবসায়ীদের অযৌক্তিক আগ্রহের ফলেও বেশ কিছু সংখ্যক শেয়ারের দর মাঝে মধ্যে যুক্তিহীনভাবে বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়।
কোন প্রভাবকসমূহ বা কোন অন্তর্নিহিত মৌল শক্তি শেয়ারের দর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে মূখ্য ভূমিকা পালন করে সে বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে হবে। সেইসাথে দুর্বল ফান্ডামেন্টালসহ কিছু সংখ্যক শেয়ারের দর অযৌক্তিকভাবে বৃদ্ধির ট্রেন্ড বা ধরন বিশ্লেষণ বিষয়ে দক্ষতা অর্জনের পাশাপাশি বাজারের আচরণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা করতে হবে।
তালিকাভুক্ত কোম্পানিসমূহের বার্ষিক বা অর্ধবার্ষিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত আশাব্যঞ্জক লাভ অর্জনের তথ্য বা এ বিষয়ে অগ্রীম ধারণা লাভ, বিশেষ শেয়ারের প্রতি স্বাভাবিক বা অস্বাভাবিকভাবে সৃষ্ট আগ্রহ এবং সংশ্লিষ্ট কোম্পানির ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা বিষয়ে স্পেকুলেশন বা জল্পনা ইত্যাদি কারণে শেয়ারের দর বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়।
তবে শেয়ার বাজার অতি সংবেদনশীল। তাই উপরোক্ত কারণসমূহ ব্যতীত দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরের আর্থ সামাজিক-রাজনৈতিক বা প্রাকৃতিক প্রেক্ষাপটের বহুবিধ ঘটনাও শেয়ারের দরকে সার্বিকভাবে বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিশেষ ধরণের শেয়ারের দরকে প্রভাবিত করে। এ সব ঘটনার ফলে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিসমূহের লাভ ক্ষতির ধারা প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্রভাবিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকার জন্যই শেয়ারের দর প্রভাবিত হয়। দূর দেশের এক তুলা ক্ষেতের তুলা উৎপাদন বৃদ্ধিজনিত কারণে দাম হ্রাস প্রাপ্ত হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে কাঁচামাল হিসেবে তুলা ব্যবহারকারী এদেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহ লাভবান হতে পারে এবং ফলশ্রুতিতে লভ্যাংশ বা অন্যান্য প্রদান বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ার ফলে সংশ্লিষ্ট শেয়ারের দর বৃদ্ধি পেতে পারে।
তথ্য প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতির ফলে গোটা বিশ্বকে বলা হয় ‘গ্লোবাল ভিলেজ’। ফলে অপেক্ষাকৃত দক্ষ বাজারে ব্যবসা বাণিজ্যের সাথে সম্পর্কিত বহু ধরনের দেশীয় ও আন্তর্জাতিক ঘটনা প্রবাহ শেয়ারের দরকে তাৎক্ষণিকভাবে প্রভাবিত করে।
তাই কোম্পানিসমূহ থেকে সর্বশেষ বাস্তব অবস্থার তথ্য প্রাপ্তির জন্য অপেক্ষা না করেই শেয়ারের দরে প্রভাব সৃষ্টিকারী বিষয়সমূহ বিবেচনার ভিত্তিতে বিজ্ঞ ব্যবসায়ীগণ কোনো কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে অপেক্ষাকৃত অগ্রীম সময়ে সঠিক শেয়ার কম বা সস্তা দরে ক্রয় করে প্রচুর লাভ অর্জন করেন বা শেয়ার বিক্রী করে ঝুঁকি থেকে বেরিয়ে আসেন।
অবশ্য শুধু কোম্পানি ফান্ডামেন্টাল সম্পর্কিত ধনাত্বক তথ্য সর্বক্ষেত্রে তাৎক্ষণিকভাবে শেয়ার দরের বৃদ্ধি ঘটায় না। তবে এর ফলে আমাদের অদক্ষ বাজারে প্রায়ই শেয়ার ব্যবসা থেকে প্রচুর লাভ অর্জন করার সুযোগ সৃষ্টি হয়। সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সর্বশেষ ব্যবসায়িক তথ্য জেনে নিয়ে প্রথম সুযোগেই সেই কোম্পানির শেয়ার ক্রয় করার কৌশল অনেক ক্ষেত্রে বেশি ফলদায়ক এবং এক্ষেত্রে ট্রেন্ড বা ধরন বিশ্লেষণের বিষয়টিও একজন ব্যবসায়ীর জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ।
শেয়ারের দর কেন বাড়ে সে সব অসংখ্য কারণের মধ্য থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হলো। তবে এক্ষেত্রে কোনো একটি কারণকে বিছিন্নভাবে সব সময়ের জন্য শেয়ারের দর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে একমাত্র বিবেচ্য বিষয় মনে করা ঠিক হবে না।
শেয়ার দর ওঠা নামার ছন্দের (!) এক পর্যায়ে দক্ষ ব্যবসায়ীগণ কর্তৃক লাভ উঠিয়ে নেওয়া জনিত বিক্রীর চাপে বাজার দরের হ্রাস প্রাপ্তির পর ক্রয়ের চাপ বৃদ্ধি !!!
বিশেষ কারণে কোনো বিশেষ শেয়ারের প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি, বিশেষভাবে নতুন ইস্যুর ক্ষেত্রে।
কোম্পানির আয় বৃদ্ধি, বৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান হার টেকসই হবার লক্ষণ। অনুকূল পিই রেশিও।
কোম্পানির বিক্রী বৃদ্ধি এবং বৃদ্ধির ক্রমবর্ধমান ধারা টেকসই হওয়ার লক্ষণ, টেকসই বাজারের নিশ্চয়তা,
অনুকূল ভবিষ্যৎ প্রতিযোগিতা, পণ্যের গুণগতমান।
লভ্যাংশ বা অন্যান্য প্রদানের ক্ষেত্রসহ সার্বিকভাবে কোম্পানি পরিচালকদের প্রতি আস্থা।
কোন নামী দামী দেশী-বিদেশী প্রতিষ্ঠানের অংশ গ্রহণ বা কোম্পানির ব্যবস্থাপনাতে অনুকূল পরিবর্তন।
সংরক্ষিত তহবিলে টাকার পরিমাণ বৃদ্ধি বা শেয়ার প্রতি সম্পদের পরিমাণ বৃদ্ধির ফলশ্রুতিতে বোনাস শেয়ার প্রাপ্তির সম্ভাবনা বা কোম্পানি কর্তৃক সম্প্রসারণ কর্মসূচি গ্রহণ অথবা নতুন ইউনিট স্থাপন সংক্রান্ত তথ্য।
কোম্পানির উৎপাদন কর্মসূচির ক্ষেত্রে মৌলিক পরিবর্তন বা এতদসম্পর্কিত পরিকল্পনা প্রণয়ন, বাস্তবায়ন বা নীতি নির্ধারণ।
বার্ষিক সাধারণ সভা ও লভ্যাংশ ঘোষণার সময় এগিয়ে আসা এবং ব্যবস্থাপনার প্রতি আস্থা।
লভ্যাংশ ঘোষণার পর পরই কিম্বা বুক ক্লোজারের সময় শেষ হওয়ার পর শেয়ারের দর বেশি মাত্রায় হ্রাস পাওয়া; যেক্ষেত্রে কোম্পানির ব্যবসায়িক পরিস্থিতির উল্লেখযোগ্য অবনতি ঘটেনি।
সাধারণ বার্ষিক সভা বা অন্য কোন সূত্র থেকে আশাবাদ সৃষ্টি হওয়ার মত কোনো ধারণা প্রাপ্তি।
ফান্ডামেন্টালের তুলনায় দাম কমে যাওয়া (ভালো ব্যবস্থাপনায় পরিচালিত কোম্পানির ক্ষেত্রে)।
কাঁচামালের দামসহ অন্যান্য উৎপাদন খরচ কমে যাওয়া, বিক্রয় মূল্য বৃদ্ধি পাওয়া, অনুকূল অবকাঠামোগত সুবিধা।
ব্যাংক ঋণ, ডিবেঞ্চারের ভার লাঘব হওয়ার কারণে সুদের খরচ থেকে অব্যাহতি প্রাপ্তি।
রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতা।
অনুকূল আমদানি, রপ্তানি ও রাজনীতি এবং সুদের হার।
অনুকূল বিশ্ব বাণিজ্যনীতি, বিশ্ব অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, প্রাকৃতিক পরিস্থিতি।
সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার উন্নতির ফলে পণ্য বা সেবার চাহিদা বৃদ্ধি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি।
প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার জন্য উৎপাদন বহুমূখীকরণ নীতি।
আবার গুজবের ভিত্তিতে শেয়ারের দর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হতে পারে। গুজব সত্য হতে পারে, মিথ্যাও হতে পারে। গুজবটি সত্য এ বিষয়ে নিশ্চিত না হয়ে শেয়ার ক্রয় করা জুয়া খেলারই নামান্তর। আপনি কি আপনার কাষ্টার্জিত মূলধন জুয়া খেলাতে বিনিয়োগ করবেন? বাস্তবে গুজবের ভিত্তিতে শেয়ার ক্রয় আগুনে ঝাঁপ দেওয়ার মতোই ক্ষতিকর।
আপনার মন্তব্য লিখুন