কেন মুনাফা করতে পারে না ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা? এ নিয়ে গতকালের লেখায় কিছু বিষয়ে আলোচনা করেছি, আজকেও কিছু বিষয় তুলে ধরব। আসলে বিনিয়োগকারীদের কিছু ভ্রান্ত ধারণাই তাদের লোকসানের মূল কারণ। কি সেই ভ্রান্ত ধারণাগুলো?
শেয়ারের দর হ্রাস-বৃদ্ধির একমাত্র কারণটি জানা আছে!
অনেক বিনিয়োগকারী মনে করেন তার কাঙ্খিত শেয়ারটির দাম বাড়ার এই কারণ, দর কমার ঐ কারণ এবং এটাই একমাত্র কারণ। আসলেই কি তাই! দেখা যাবে অনুসন্ধান করে জানতে পারবেন, শেয়ারের দাম বাড়ার ও কমার যে কারণটি আপনি জানেন তা আসলে সঠিক নয়- কিংবা তারপরে আরো কারণ আছে। কাজেই আপনি সর্বশেষ কারণটি জানেন না। কিন্তু জিততে হলে আপনাকে জানতে হবে।
বিনিয়োগকারীদের আরো ভ্রান্ত ধারণা রয়েছে। যেমন: `বাংলাদেশের শেয়ারবাজার কোনো নিয়ম নীতি মেনে চলে না, কোন শেয়ারটির দর উঠবে, কোনটির দর নামবে এ বিষয়টি ম্যানিপুলেটররাই নির্ধারণ করেন। তাই পুথিগত বিদ্যা এখানে অচল। শেয়ার ব্যবসাতে জয়ী হওয়া নিছক ভাগ্যের ব্যাপার।’ এমন সব ধারণাকে সঠিক এবং সর্বশেষ ধারণা মনে করা একজন শেয়ার ব্যবসায়ীর জন্য যেমন ক্ষতিকর তেমনি একটি দক্ষ পুঁজি বাজার গড়ে উঠার পথেও বড় প্রতিবন্ধক।
ঢাকা ষ্টক এক্সচেঞ্জ বা বিশ্বের যে কোনো দেশের শেয়ার বাজারের মূল্য সূচক পর্যবেক্ষণ করলে আপনি জানবেন ঐ সূচক কোন একক সময়ে ক্রমাগতভাবে বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়ে যেমন সর্বোচ্চ শিখরে পৌছেনি, তেমনি ক্রমাগতভাবে হ্রাসপ্রাপ্ত হয়ে সর্বনিন্ম স্তরে নামেনি। সূচক বৃদ্ধির পর হ্রাসপ্রাপ্ত হবে এবং হ্রাসপ্রাপ্তির পর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হবে, এটাই চাঙ্গা এবং মন্দা উভয় সময়ে শেয়ার বাজারের স্বাভাবিক ধর্ম।
শেয়ারের দর কখন, কোন পরিস্থিতিতে, কীভাবে হ্রাস-বৃদ্ধি ঘটে, তার কারণ ও ধরন বিষয়ে বাজার বিশেষজ্ঞগণ বৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ ভিত্তিক দিক নির্দেশনা দিয়েছেন। এ সকল দিক নির্দেশনা বা কৌশল কাজে লাগিয়ে এদেশের শেয়ার বাজারের অনেকে, এমনকি মন্দা বাজারেও প্রচুর লাভ অর্জন করে থাকেন।
প্রকৃতপক্ষে জ্ঞানার্জনের প্রচেষ্টা থেকে নিজকে দূরে রেখে কিছু ভ্রান্ত ধারণাকে দুনিয়ার সর্বশেষ এবং একমাত্র সঠিক ধারণা মনে করার অর্থ নিজেকে ঠকানো। সফল শেয়ার ব্যবসায়ী হতে হলে আপনাকে শেয়ার ব্যবসায়ের আধুনিক সময়ের সর্বশেষ কলাকৌশল বিষয়ে জ্ঞানার্জনের জন্য সদা সচেষ্ট থাকতে হবে।
ভাগ্যের উপর দোষ চাপিয়ে সন্তুষ্ট থাকার প্রবণতা
‘আমি শেয়ার বিক্রী করার পর দাম বাড়ে আর ক্রয় করার পর দাম কমে। ভাগ্য আমার প্রতি সুপ্রসন্ন নয়’- অনেকেই এ ধরনের মন্তব্য করে থাকেন। একজন টাইকুন কিন্তু ভাগ্যের উপর দোষ চাপানোর এহেন ব্যাখ্যাকে দুনিয়ার সর্বশেষ এবং একমাত্র গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা মনে করে সন্তুষ্ট থাকেন না। বরং কেন এমন ঘটে তার কারণ খুঁজতে তিনি সদা সচেষ্ট থাকেন। আবার অনেকে ধৈর্যহারা হয়ে প্রতিনিয়ত অহেতুক পোর্টফোলিও পরিবর্তন করে থাকেন। ফলে লাভ হাতছাড়া হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে অসহিষ্ণুতা, ধৈর্যহীনতার বিষয়টি যেমন ভাবতে হবে তেমনি শেয়ারের দর উঠানামার ঐতিহাসিক ধরন এবং কারণ বিশ্লেষণেও দক্ষ হতে হবে।
শেয়ারের দর যে পর্যায়ে নামার পরে অতীতের বিভিন্ন সময়ে পুনরায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে, সে দরের কাছাকাছি দামে আপনি শেয়ারটি বিক্রী করছেন কিনা কিম্বা ক্রয়ের ক্ষেত্রে এর বিপরীত ধর্মী ঘটনা ঘটছে কিনা সে বিষয়সহ বহুবিধ পরিস্থিতি যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করুন।
পড়তি বাজারের পরিবর্তে উঠতি বাজারের শেষ পর্যায়ে ঝুঁকি নেবার প্রবণতা
শেয়ারের দর কয়েক দিন যাবত ক্রমাগতভাবে নীচে নামছে। কয়েক সপ্তাহ, কয়েক মাস, এমনকি কয়েক বছরের মধ্যে শেয়াটির দর সর্বাপেক্ষা নীচে নেমে এসেছে। অবশ্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানিটির ব্যবসা বা লাভ অর্জনের পরিস্থিতি সন্তোষজনক। শেয়ারটিতে বিনিয়োগের আকর্ষণীয় সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। অথচ এ মুহুর্তে শেয়ারটি কিনছেন না দর আরও পড়ে যাওয়ার ভয়ে। পরবর্তীতে স্বাভাবিকভাবেই শেয়ারটির দর বৃদ্ধি পেতে থাকে। বৃদ্ধির শুরটাও এক্ষেত্রে ক্রয়ের জন্য অতিশয় সম্ভাবনাময়। অথচ তখনও শেয়ার ক্রয় করা বিষয়ে সিদ্ধান্তহীতায় ভুগছেন। এহেন সিদ্ধান্তহীনতার মাঝে দর অনেক বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। যিনি অনেক কম দামে শেয়ারটি ক্রয় করছিলেন না তিনিই এক পর্যায়ে অনেক বেশি দামে, অনেক বেশি ঝুকিতে শেয়ারটি ক্রয় করে পরবর্তীতে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে থাকেন। এ ধরনের মানসিকতা বাদ দিয়ে পড়তি বাজার থেকে অপেক্ষাকৃত কম মূল্যে শেয়ার ক্রয় করে ঝুঁকি নেয়ার কৌশলই উত্তম পন্থা। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে দর বৃদ্ধির শুরুতে ক্রয় করে তাৎক্ষণিকভাবে লাভ অর্জনের সুযোগও থাকে।
শেয়ার কেনাবেচা বিষয়ে বিচারকের দৃষ্টিভঙ্গির ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে ব্যর্থতা
একজন বিচারকের দৃষ্টিভঙ্গী নিয়ে শেয়ার কেনা বেচার দর নির্ধারণে ব্যর্থতার কারণে অনেকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হন। লোভ-লালসা, ভয়-ভীতি, আবেগ-অসহিষ্ণুতা প্রভৃতি বিষয়াবলি মানবীয় বিবেচনাবোধের উপর গভীরভাবে প্রভাব বিস্তার করে। আজকের বাড়তি বাজারে যে শেয়ারটির উচিত দর আপনার অতি আশাবাদী দৃষ্টিতে ২৫০ টাকা, আগামী কাল শেয়ারটির দর পতন শুরু হলেই মনে হবে শেয়ারটির উচিত দর ১১০ টাকা। শেয়ারটির দর বিষয়ক সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে লোভ, ভয়, আবেগ, অসহিষ্ণুতা প্রভৃতি বিষয় বিবেচনাবোধকে প্রভাবিত করে। কোনো একটি বিশেষ সময়ের বিশেষ এক পরিস্থিতিতে কোনো একটি শেয়ারের ক্রয়-বিক্রয় মূল্য কত হওয়া উচিত তা নির্ধারণ করার জন্য আপনাকে মনস্তাত্বিক বাধার উর্দ্ধে উঠে বিচারকের ভূমিকাতে অবর্তীণ হতে হবে। এজন্য কোম্পানি ফান্ডামেন্টাল ও টেকনিক্যাল বিশ্লেষণভিত্তিক দর নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে আপনাকে দক্ষ হতে হবে।
কিভাবে একটি কোম্পানির ফান্ডামেন্টাল ও টেকনিক্যাল বিশ্লেষণ করে আপনি শেয়ার কেনাবেচার ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন সে বিষয়ে আগামি লেখাগুলোতে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
আপনার মন্তব্য লিখুন