একটি ভালো কোম্পানি চিনবেন কিভাবে?

এস. এম. হোসেন
শনিবার , ০২ জানুয়ারী ২০১৬

কিভাবে শেয়ার ব্যবসায় সফল হবেন? প্রতিদিন হাজারো বিনিয়োগকারীর একই প্রশ্ন। প্রশ্নটির উত্তর দেয়া যায় এক কথাতেই। তাহলো, দেখে শুনে বুঝে শেয়ার কিনলে খুব সহজেই মুনাফা করা যায়। কিন্তু কিভাবে বুঝবেন, আপনি যে কোম্পানির শেয়ার কিনছেন, সেটি ভালো কোম্পানি। আবার শুধু ভালো কোম্পানি হলেইতো হবে না- কখন কিনবেন, কি দামে কিনবেন সেই কোম্পানির শেয়ার? আবার শুধু কিনলেইতো হবে না, বিক্রি করতে হবে সঠিক সময়ে, সর্বোচ্চ মুনাফায়। তাহলেই না- আপনি লাভবান হবেন।

প্রিয়, বিনিয়োগকারী এসব কিছু জানাতেই মার্কেটট্রেন্ডবিডিডটকম-এ ধারাবাহিভাবে প্রকাশিত হচ্ছে ‘কিভাবে শেয়ার ব্যবসায় সফল হবেন’? আজকের বিষয় ‘একটি ভালো কোম্পানি চিনবেন কিভাবে?’
লিখেছেন শেয়ারবাজার গবেষক, বিনিয়োগ পরামর্শক, প্রাক্তন ব্যাংকার ও ‘বুদ্ধির খেলা- শেয়ারব্যবসা’ বইয়ের লেখক এস.এম. হোসেন

সফল বিনিয়োগকারী হয়ে ওঠার অদম্য ইচ্ছা আর পরিশ্রমই আপনাকে আপনার লক্ষ্যে পৌঁছে দেবে। গতকালের লেখায় বলেছি, শেয়ারবাজার নিয়ে গবেষনা করে নিত্যনতুন বিনিয়োগের সুযোগ খুঁজে বের করুন। অন্যেরা যে ব্যবসায়িক সম্ভাবনার সন্ধান পাবে আগামীকাল, একজন টাইকুন ব্যবসায়ী হিসেবে আপনাকে আজই সেই শেয়ারটি ক্রয়ের সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
কিন্তু এখন কথা হলো, শেয়ার নির্বাচন করবেন কিভাবে? সহজ কথা, কিভাবে চিনবেন একটি ভালো কোম্পানি?
খুব সহজ! মনে করুন আপনি একটি জমি কিনবেন। তাহলে কি করবেন? জমির কাগজপাতি নিয়ে খাওয়া দাওয়া ভুলে ঘাটঘাটি শুরু করে দেবেন। প্রয়োজনে উকিল সাহেবের কাছে দৌঁড়াবেন। জমির কাগজপাতি ঠিক আছে কিনা? এরপর দেখবেন বিক্রেতা জমির দাম বাজারদর অনুয়ায়ী চাচ্ছে কিনা? জমিটা কোথায়? সম্ভাবনা কেমন? এখন এই জমি যে দামে কিনছেন ভবিষ্যতে তার দাম কত বাড়তে পারে। তারপর সেই জমির আশেপাশের প্রতিবেশিরা কেমন? কারণ, শুধু জমি কিনলেই-তো হবে না! সেখানেতো বসবাস করতে হবে। এরপর জমি কেনার পরও তো কত ঝক্কিঝামেলা। নিজের নামে খারিজ করাও, খাজনা দাও আরো কত কি?

প্রিয়, বিনিয়োগকারী একটি জমি কিনতে আপনি যখন এত পরিশ্রম করছেন তখন একটি শেয়ার কিনতে তা করছেন না কেন? শেয়ারতো জমির মতোই। কোন কোম্পানির শেয়ার কেনা মানেইতো সেই কোম্পানির মালিক হওয়া। তাহলে কষ্টতো আপনাকে করতেই হবে!

খুব বেশি কিছু না আপনি কোম্পানিটির পরিচালনা পর্ষদে কারা আছেন, কোম্পানির গত ৫ বছরের ( কমপক্ষে) আয় ধারাবাহিকভাবে বেড়েছে কিনা , কোম্পানি যে পণ্যের ব্যবসা করে তার সম্ভাবনা কেমন, পিই রেশিও, আরএসআই, মাত্র এই কয়টি বিষয় দেখেলেই অপনি নিজেই একটি ভালো কোম্পানি চিনতে পারবেন। মনে রাখবেন, একটি কোম্পানির পরিচালনা পর্ষদ খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কোনভাবেই এক্ষেত্রে ছাড় দেবেন না।
কোন কোম্পানির ‘আরএসআই’ মান ৩০ এর বেশি হলে সেই কোম্পানির শেয়ার কোনভাবেই কিনবেন না। ২০১০-এর ধ্বসের সময় শেয়ারবাজারের সামগ্রিক আরএসআই মান ছিল ৯০-এর উপরে।

কোন বিনিয়োগকারি আমার লেখা পড়ে মনে করতে পারেন, আমি যত সহজে কথাগুলো বলছি ব্যাপারটা তত সহজ কিনা। ব্যাপারটা আসলেই সহজ। জিততে হলে আপনাকে জানতে হবে, শিখতে হবে। এবং সব থেকে যেটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তাহলো যা জেনেছেন, শিখেছেন তা মানতে হবে। মানতেই হবে।
আপনি যদি একটু অনুসন্ধ্যিৎসু হয়ে শেয়ার ব্যবসায়ের মাধ্যমে প্রচুর অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছেন এমন সব শেয়ার ব্যবসায়ীর সান্নিধ্যে আসেন তাহলে ঐ সকল ব্যবসা সফল ব্যক্তির জ্ঞানের গভীরতা উপলদ্ধি করে মুগ্ধ হবেন।

পৃথিবী বিখ্যাত বিনিয়োগগুরু ওয়ারেন বাফেটের নাম শোনেননি এমন বিনিয়োগকারি খুঁজে পাওয়া যাবে না। কি করতেন বাফেট। তার কাছে সবসময় থাকতো একটি রাফখাতা। আর সেই রাফখাতায় তিনি লিখে রাখতেন কোম্পানির আয়, পিই রেশিওসহ বিভিন্ন তথ্য।

ওয়ারেন বাফেটের মতে, সফল প্রতিষ্ঠানের গ্রস প্রফিট মার্জিন থাকে সাধারণত ৫০-এর ওপর। বিনিয়োগের আগে তিনি এ ছোট্ট হিসাবটি সবসময় করেন। তার রাফ খাতায় লেখাই থাকে অনেক প্রতিষ্ঠানের গ্রস প্রফিট মার্জিন। যেমন- কোকাকোলার গ্রস প্রফিট মার্জিন ৬০ (স্থিতিশীল), রেটিং কোম্পানি মুডিস ৭৩, বার্লিংটন নর্দান রেলরোড ৬১ ও রিগলি গামের ৫১ শতাংশ প্রভৃতি। ঝুঁকিপ্রবণ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের তালিকায় গ্রস প্রফিট মার্জিনের উল্লেখ ছিল এভাবে ইউনাইটেড এয়ারলাইনস (আপদমস্তক দেউলিয়া) ১৪, জেনারেল মোটরস ২১ (পক্ষাঘাতগ্রস্ত) ও ইউএস স্টিল ১৭ শতাংশ (মাঝে মধ্যে লোকসানেও পড়ে)। মজার একটি বিষয় লক্ষ্য করা যায় বাফেটের খাতায়। গাড়ির চাকার ব্যবসার নির্দিষ্ট সিজন নেই। অনেকের ধারণা সারা বছরই যেহেতু চলে; এ ব্যবসায় লস নেই। আসলে ধারণাটি ভুল। বাফেট উল্লেখ করেছেন, গুডইয়ার টায়ারের গ্রস প্রফিট মার্জিন ২০ শতাংশ। তার মানে এ ধরনের ব্যবসার অন্তর্নিহিত অর্থনীতি শক্তিশালী নয়।

বাফেটের বিনিয়োগ নীতি
বাফেট বলেন, ১৫ পিইর ঊর্ধ্বে শেয়ারে বিনিয়োগ কখনও ভালো বিনিয়োগ হতে পারে না । এবং তিনি অসৎ শিল্পপতিদের কোম্পানির ক্ষেত্রে দৃঢ মনোভাব পোষন করেন।

অধিকাংশ বিশেষজ্ঞ বিনিয়োগকারীদের প্রতি উপদেশ দেন যে, তারা যেন শেয়ার বিনিয়োগে বহুমুখিতার নীতি অবলম্বন করেন। যার অর্থ তারা শেয়ার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের কোম্পানির শেয়ারের মাধ্যমে তাদের পোর্টফোলিওটি যেন সাজান। এতে ধারণা করা হয়, তাদের বিনিয়োগে ক্ষতির পরিমাণ কম হওয়ার একটি সম্ভাবনা থাকবে।

তবে বাফেট মনে করেন, আপনি যদি সঠিক কোম্পানিটি পেয়ে যান, তাহলে কেন বিনিয়োগকারী হিসেবে আপনি অল্প টাকা সেই শেয়ারে বিনিয়োগ করবেন। তিনি বিশ্বাস করেন ম্যাক ওয়েস্টস দর্শনমতে, একটি ভালো শেয়ারে সর্বোচ্চ বিনিয়োগই সবচেয়ে ভালো পন্থা। বাফেট শেয়ার বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সবসময় বহুমুখিতার নীতিবিরোধী, এটাই বিনিয়োগকারী হিসেবে সাফল্যের ইতিহাস।

তবে অনেক বিনিয়োগ পরামর্শক পরামর্শ দেন যে, আপনার পোর্টফোলিওর ক্ষেত্রে এক ঝুড়িতে সব ডিম রাখা ঝুঁকিপূর্ণ ও ক্ষতিকর। আপনি যদি অনেক কোম্পানির শেয়ার দিয়ে আপনার বিনিয়োগ সাজান, তাহলে সেটা কম ঝুঁকিপূর্ণ হবে। অথচ বাফেট সারাজীবন এর বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছেন। তার মতে, বিনিয়োগকারীরা যদি কেবল ৫টি ভালো কোম্পানিতে সঠিকভাবে বিনিয়োগ করতে পারেন, তাহলে তার সঠিক বিনিয়োগের মাধ্যমে আর্থিকভাবে যে কেউ লাভবান হতে পারেন।

বাফেট যখন নিজের জীবনে একটি ভালো কোম্পানির সঠিক দামের সন্ধান পেয়েছেন, তিনি তার সর্বোচ্চ বিনিয়োগ করেছেন। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, তিনি কোকাকোলা কোম্পানির শেয়ারের ক্ষেত্রে এক বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছিলেন, যা ছিল কোকোকোলার ২০০ মিলিয়ন শেয়ার। আমেরিকান এক্সপ্রেস-এর শেয়ারের ক্ষেত্রে ১৫১ মিলিয়ন শেয়ার, পেট্রো চীনা: চীনা অয়েল কোম্পানির ক্ষেত্রে তিনি বিনিয়োগ করেছিলেন ৪৮৮ মিলিয়ন ডলার। আজকে যার বাজারমূল্য ১.২ বিলিয়ন বা ১২০০ মিলিয়ন ডলার।

২০০৪ সালে বার্কশায়ার হ্যাথাওয়ে ১০টি কোম্পানির শেয়ারে তাদের বিনিয়োগ করেছিল, যা ছিল তাদের কোম্পানির ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি কোম্পানিতে বিনিয়োগ। যদিও অধিকাংশ সময় বাফেটের এই কোম্পানি মাত্র ৫টি কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করত। বাফেট মনে করেন, সঠিক মূল্যে আপনি যদি একটি ভালো কোম্পানির শেয়ারে সর্বোচ্চ টাকা বিনিয়োগ করতে পারেন, তাহলে তা আপনাকে সবচেয়ে ভালো আর্থিক ফল দেবে।

বিনিয়োগকারী হিসেবে যদি একটি ভালো কোম্পানি পান, তবে কেন আপনি আপনার অধিকাংশ বিনিয়োগ সেই কোম্পানিতে করবেন না, তার বদলে দুর্বল ২০টি কোম্পানিতে আপনার অর্থ বিনিয়োগ করবেন?

তবে এক্ষেত্রে আপনার ধৈর্যের পাশাপাশি সঠিক কোম্পানি নির্বাচন সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে। অল্প কয়েকটি ভালো কোম্পানির শেয়ারে সঠিক বিনিয়োগই আপনার জীবন পাল্টে দিতে পারে। চলবে…