প্রকৃতপক্ষে পোর্টফোলিও সাজানোর দক্ষতার উপরেই শেয়ার ব্যবসার সফলতার মাত্রা অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাই পোর্টফোলিও সাজানোর বিষয়টি অনেক গুরুত্বপূর্ণ। পোর্টফোলিও সাজিয়ে ঝুঁকির মাত্রা কমিয়ে আনা এবং স্থিতিশীল আয় নিশ্চিত করার জন্য বহুবিধ কৌশল রয়েছে। এ বিষয়ে দিকনির্দেশনা দিয়ে বিশ্বজোড়া খ্যাতি অর্জনকারী একজন গবেষক হচ্ছেন হ্যারি এম. মার্কভিজ। তার তত্ত্বের মূল কথা হলো, পরষ্পর বিচ্ছিন্ন হাতিয়ার দ্বারা বিনিয়োগকে বহুমুখীকরণের সাহায্যে ঝুঁকির মাত্রা কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু আমরা কি করি? কিভাবে আমরা আমাদের পোর্টফোলিও সাজাই।
প্রিয়, বিনিয়োগকারি আসুন, আমরা জেনে নেই পোর্টফোলিও সাজাতে গিয়ে আমরা কি ভুল করি…
মোট বিনিয়োগকে কয়েকভাগে ভাগ করে এমন কয়েকটি কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ করা হয় যেকটি শেয়ার একই প্রকৃতির। সব কটির দামই সাধারণত একই সময়ে এবং মোটামুটিভাবে একই হারে হ্রাসবৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়। এক্ষেত্রে প্রতিটি কোম্পানিতেই যেহেতু সমান ঝুঁকি রয়েছে সেহেতু একই ধরনের কয়েকটি কোম্পানিতে বিনিয়োগ করে লাভ বৃদ্ধি কিম্বা ঝুঁকির মাত্রা কমানোর সুযোগ থাকে না।
অনেককে দেখা যায়, দামের বিষয় বিবেচনাতে না নিয়ে শুধু ফান্ডামেন্টালকেই বিনিয়োগের ক্ষেত্রে একমাত্র বিবেচ্য বিষয় মনে করেন। মূল্য সংশোধনের স্বাভাবিক রীতিতে যখন সংশিষ্ট কোম্পানির শেয়ারের দর পতন শুরু হয় তখন তারা ক্ষতিগ্রস্থ হন।
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ভিন্নভাবে পোর্টফোলিও সাজানো বা কোন বিশেষ শেয়ারে ভুল বিনিয়োগ থেকে বেরিয়ে না আসার ফলে অনেকে অসহনীয় ক্ষতির সম্মুখিন হন।
বিশেষ একটি খাতের কয়েকটি শেয়ারে একটি বিশেষ দরের স্তরে (বিশেষভাবে পড়তি বাজারে) সমুদয় মূলধন বিনিয়োগ করে অর্থের অভাবে পরবর্তীতে ভালো সুযোগ ধরতে ব্যর্থতা।
অতীতের ভালো শেয়ার সব সময়ের জন্যই আকর্ষণীয় থাকবে এমন কোনো কথা নেই। অথচ এ ধরনের বাস্তবতাকে অনেকে বিবেচনার বাহিরে রেখে কেবল অতীতে ভালো লাভ প্রদানকারী কয়েকটি শেয়ারে সমুদয় মূলধন বিনিয়োগ করার ফলে নতুন ব্যবসায়ের সুযোগ ধরতে ব্যর্থ হয়।
বিশেষ কিছু সংখ্যক ভালো ফান্ডামেন্টালধারী কোম্পানির শেয়ারের দর বিভিন্ন পরিস্থিতিতে একই সাথে হ্রাস বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয় আবার দীর্ঘদিন একই স্তরে স্থির থাকে। অথচ উক্ত শেয়ার কটির দর যখন বেশ কিছুদিন যাবত স্থির থাকছে সে সময়ে অন্য কিছু শেয়ারের দর বৃদ্ধি প্রাপ্ত হতে থাকে। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন শেয়ারের দর এভাবে হ্রাস বৃদ্ধি হওয়ার বিষয়টি অনেক সময় বিবেচনাতে নেয়া হয় না। ফলে বেশ কিছু দিন একই স্তরে স্থির রয়েছে এমন শেয়ার ক্রয় করে অনেক শেয়ার ব্যবসায়ী অন্যান্য সুযোগ ধরতে ব্যর্থ হন এবং এক পর্যায়ে শেয়ার ব্যবসা লাভজনক নয় এমন ভ্রান্ত ধারণার ভিত্তিতে কেউ কেউ শেয়ার ব্যবসা ত্যাগ করেন। পরে দেখা যায় বিক্রী করার পর পরই ভালো ফান্ডামেন্টালধারী শেয়ার কটির দর বৃদ্ধি প্রাপ্ত হয়েছে। ধৈযচ্যুতিই এক্ষেত্রে লাভ ধরতে ব্যর্থতার অন্যতম কারণ।
অনেক ক্ষেত্রে ফান্ডামেন্টাল এবং ভবিষ্যত সম্ভাবনাকে যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয় না। তাহলে কিভাবে সাজাবেন আপনার পোর্টফোলিও…
ফান্ডামেন্টাল অথবা ট্রেন্ড বা উভয়কে বিবেচনাতে নিয়ে পরস্পর বিচ্ছিন্ন অথচ সম্ভাবনাময় শেয়ারসমূহে বিনিয়োগ করতে হবে।
ক্রয়ের পূর্বে সংশিষ্ট কেম্পানি বিষয়ে খোজখবর নিতে হবে। ক্রয়ের পরে নয়।
লভ্যাংশ প্রদান ও ব্যবসায়ের প্রবৃদ্ধির ধারা বিবেচনা করে শেয়ার চিহ্নিত করতে হবে।
পতনশীল বাজারেও বৃদ্ধি পায়, ভালো ফান্ডামেন্টালের এমন শেয়ার ক্রয়ে অগ্রাধিকার দিতে হবে।
কম ঝুঁকিতে ব্যবসা করার জন্য শেয়ারের দর তেমন বেশি হ্রাস বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয় না কিন্তু উচ্চ লভ্যাংশ প্রদান করে এমন শেয়ার বেছে নিতে হবে।
আত্মস্বীকৃত বিশেষজ্ঞদের বিষয়ে সতর্ক থাকুন। তারা মূলত স্বল্পকালের জন্য পরামর্শ দিয়ে থাকেন যা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের জন্য বিপদজনক হতে পারে।
উচিত মূল্যে ক্রয় করে বর্ধনশীল কোম্পানির শেয়ার ৩-৪ বছর ধরে রাখুন।
প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনা বেশি এমন খাতের প্রতি দৃষ্টি দিন।
প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে টেকসই সুবিধা বিদ্যমান কিনা দেখুন।
বছরের বিশেষ সময়ে; যেমন- কোম্পানির বর্ষ বা অর্ধবর্ষ সমাপ্ত হওয়া বা বার্ষিক সভার কিছু দিন পূর্বে শেয়ারের দর বৃদ্ধি প্রাপ্ত হওয়ার বিষয় বিবেচনাতে নিতে হবে।
একাধিক কোম্পানিতে এমনভাবে বিনিয়োগ করতে হবে যার ফলে কোনো একটি বা এক ধরনের কিছু সংখ্যক কোম্পানি বিশেষ কোনো অনাকাঙ্খিত সমস্যাতে পরিণত হলে অন্যান্য কোম্পানিসমূহের লাভ দিয়ে সম্ভাব্য অনাকাঙ্খিতভাবে সৃষ্ট সমস্যাজনিত লোকসান কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়।
শেয়ার দরের বিষয়টিকে ফান্ডামেন্টাল বিবেচনা অপেক্ষা বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। অযৌক্তিক উচ্চ মূল্যে কোনো শেয়ার ক্রয় করা হলে ফান্ডামেন্টাল সেক্ষেত্রে রক্ষাকবচ হতে পারে না। তাই কোম্পানি ফান্ডামেন্টাল এবং ট্রেন্ড বিবেচনাতে নিয়ে উচিত দরে শেয়ার ক্রয় করে পোর্টফোলিও সাজাতে হবে। এক্ষেত্রে পিই রেশিও, ঋণ, নিজ মূলধন অনুপাত দিকনির্দেশক হতে পারে।
যারা অপোকৃত কম ঝুঁকিতে বা অল্প অথচ বিকল্প বিনিয়োগ সুবিধা অপেক্ষা সামান্য বেশি মুনাফাতে সন্তুষ্ট থাকতে চান তাদের ক্ষেত্রে নিরাপত্তা ও স্থিতিশীল আয়ের স্বার্থে উচ্চ হারে লভ্যাংশ প্রদানের রেকর্ডসহ কোম্পানির ক্রমবর্ধমান আয় বা বর্ধনশীল শেয়ার, ব্যবস্থাপনার সততা ও দক্ষতা, বিনিয়োগের নিরাপত্তা, কর মুক্তির সুবিধা ইত্যাদি বিষয় বিবেচনা করতে হবে।
কোনো একসময়ে বিশেষ কিছু সংখ্যক শেয়ার ছিলো অতি নামী এবং ব্যবসায়িক সম্ভাবনাময়। বিগত দিনের ঐ সব ব্লুচিপ শেয়ারের বর্তমানে কদর নেই। বর্তমান সময়ের এ ধরনের ট্রেন্ডসমূহও অনুধাবন করতে হবে। অবশ্য এক্ষেত্রে পুঙ্খানুপুঙ্কভাবে ঝুঁকির মাত্রা এবং অন্যান্য বিষয় বিবেচনা করে মাঝে মধ্যে পোর্টফোলিও সময়োপযোগী করে সাজাতে হবে। মুমূর্ষু কোম্পানির শেয়ারে বিনিয়োগ পরিহার করতে হবে।
হঠাৎ করে একদিন শেয়ার বাজারে এসে সমুদয় মূল্যধন বিনিয়োগ না করে ধীরে সুস্থে বিভিন্ন সম্ভাবনার আলোকে, বিভিন্ন কৌশলে সতর্কতার সাথে পোর্টফোলিও সাজাতে হবে।
আর্থিক সঙ্গতি, পেশা, বয়স, বিনিয়োগযোগ্য মূলধন ইত্যাদি বিষয়ও পোর্টফোলিও সাজানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে হবে। মনে রাখবেন, সব শেয়ার যেমন সবার জন্য উপযুক্ত নয় তেমনি তালিকাভুক্ত কোম্পানিসমূহেরও রয়েছে প্রকারভেদ। প্রত্যেকটি শেয়ারের প্রয়োজনীয়তা এবং উপযোগিতার মধ্যে রয়েছে ভিন্নতা।
পোর্টফোলিও সাজানোর ক্ষেত্রে কোম্পানিসমূহের যেসব দিক বিবেচনা করতে হবে …
আকর্ষণীয় প্রবৃদ্ধি / আকর্ষণীয় পণ্য/পণ্য বহুমুখীকরণ।
সম্প্রসারণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন বা নতুন ব্যয় সাশ্রয়ী প্রযুক্তি স্থাপন বা স্থাপনের পরিকল্পনা। ব্যবস্থাপনার যোগ্যতা।
কম শেয়ার সংখ্যা অথচ আকর্ষণীয় ব্যবসায়িক প্রবৃদ্ধি।
বাজারের শীর্ষস্থানে পণ্য বা সেবার অবস্থান।
নতুন পণ্য, নতুন অথচ যোগ্য ব্যবস্থাপনা, নতুন টেকনোলজী।
শুধু কম দামে ক্রয় করার কৌশল সর্বক্ষেত্রে লাভের নিশ্চয়তা দেয় না, তাই শেয়ারটির অর্ন্তনিহিত শক্তিভিত্তিক মূল্যও প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে যথাযথভাবে বিবেচনা করতে হবে।
দর উঠানামার ধরনের বিষয়টিও ব্যবসায়ীদের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূণ।
মনে রাখবেন; সবচেয়ে বেশি লাভ ধরার জন্য শুধু বোকারাই অপেক্ষা করে। তাই, সর্বোচ্চ লাভের স্তরে পৌঁছার কিছুটা পূর্বেই শেয়ারটি বিক্রী করে দিন।
এবং প্রয়োজনবোধে সঙ্গেসঙ্গে ভুল স্বীকার করে নিন এবং কম লোকসানে শেয়ারটি বিক্রী করে দিন।
এক সময়ের সাজানো পোর্টফোলিও সব সময়ের জন্য গ্রহণযোগ্য বা লাভজনক নাও হতে পারে। তাই পরিস্থিতি নিয়মিতভাবে পর্যালোচনা করতে হবে এবং প্রয়োজনবোধে ভিন্নভাবে পোর্টফোলিও সাজাতে হবে। এর ফলে বিশেষ সময়ের বিশেষ পরিস্থিতিতে, ঝুঁকিবহুল হয়ে ওঠা বিনিয়োগ, যথাসময়ে হস্তান্তর করে যেমন সম্ভাব্য ক্ষতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয় তেমনি উক্ত পরিস্থিতিতে লাভজনক হয়ে ওঠা শেয়ার ধারন করে মুনাফা বৃদ্ধি করাও সম্ভব।
আপনার মন্তব্য লিখুন